পেজার-ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ: আসলে কি ঘটছে লেবাননে?

আন্তর্জাতিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৩:০৯:৫১পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ হঠাৎ করে বিপাকে পড়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে ব্যবহার করা পেজার যন্ত্রগুলোতে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার একদিন পরই হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত হাজারো ওয়াকিটকিতেও বিস্ফোরণের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এমনকি লেবাননেরর বিভিন্ন অঞ্চলে সৌর বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র, মুঠোফোন ও মোবাইলে বিস্ফোরণ ঘটার খবর পাওয়া গেছে।

এসব ঘটনার নেপথ্যে কারা?
পেজার-ওয়াকিটকিসহ সব বিস্ফোরণের ঘটনায় হিজবুল্লাহ ইসরাইলকে দায়ী করছে। তাদের দাবি, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বহুদিন ধরেই পরিকল্পনা করে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এ বিষয়ে ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু ইসরায়েলি বিভিন্ন মন্ত্রী ও সেনা কর্মকর্তার কথায় এই হামলার পেছনে যে ইসরায়েলই দায়ী তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কিভাবে পেজারে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো?
পেজার মূলত ছোট এবং বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস। সংক্ষিপ্ত বার্তা বা সতর্কতা পাঠাতে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ পেজার বেস স্টেশন থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে মেসেজ বা বার্তা পাঠায় ও গ্রহণ করে। এই বার্তা কোনও সংখ্যা হতে পারে, আবার কোনও শব্দবন্ধও হতে পারে। এই ডিভাইসটির ছোট স্ক্রিনে সেই বার্তা দেখা যায়। যখন পেজারে কোনও বার্তা আসে, তখন এতে শব্দ হয়, ঠিক যেমন মোবাইলে মেসেজ আসলে নির্দিষ্ট টিউন বাজে। অনেক দেশে বিপার নামেও পরিচিত পেজার। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে বহুল ব্যবহার হত পেজারের। পেশাদার লোকজন অফিসের বাইরেও একে অপরকে দ্রুত কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়ার জন্য পেজার ব্যবহার করতেন। জরুরি পরিষেবাগুলিতে চিকিৎসক, নার্সদের কাছে এটি একটি দরকারি ডিভাইস ছিল। যেহেতু পেজারে মোবাইল নেটওয়ার্কের দরকার পড়ে না, তারহীন এই যন্ত্রে বার্তা আসে, তা দেখা যায়; কিন্তু এই যন্ত্রের মাধ্যমে ফোন করা যায় না। তাই এটি যোগাযোগের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হত।

বিশ্ব গণমাধ্যমের খবর বলছে, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ক্রয় করা পাঁচ হাজার পেজারের ভেতরে কৌশলে বিস্ফোরক জমিয়ে রেখেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার কয়েক মাস আগে থেকেই তারা গোপনে এই কাজটি করে। লেবাননের নিরাপত্তা সূত্রের দাবি, পেজারগুলো তাইওয়ানভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির। এই কোম্পানি থেকেই পাঁচ হাজার পেজার কেনে হিজবুল্লাহ। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে পেজারের চালানটি লেবাননে পৌঁছায়। তবে গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির দাবি, বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজে ব্যবহৃত পেজারগুলো উৎপাদন করেছে অন্য কোম্পানি। ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠানের গোল্ড অ্যাপোলোর ব্র্যান্ড ব্যবহারের অনুমতি ছিল। হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, উৎপাদন পর্যায়েই পেজারগুলোয় মডিফাই বা পরিবর্তন করা হয়। আর সূক্ষ্ম কৌশলে এই কাজটি করে মোসাদ।

লেবাননের সূত্রের দাবি, মোসাদ পেজার যন্ত্রের ভেতরে একটি বিশেষ বোর্ড ঢুকিয়ে দেয়। আর সেই বোর্ডেই লুকিয়ে রাখা হয় বিস্ফোরক উপাদান। আর সেই বোর্ডে এমন চিপস লাগানো ছিলো যা বিশেষ সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারদর্শী। আর সেই লুকিয়ে রাখা বোর্ড বা বিস্ফোরক শনাক্ত করাও ছিল খুব কঠিন। কোনো যন্ত্র বা স্ক্যানার দিয়েও তা শনাক্ত করা যায়নি। লেবাননেরর দাবি, যে পেজারগুলো বিস্ফোরিত হয়েছে, সেগুলো বিস্ফোরণের আগে সাংকেতিক বার্তা পাঠানো হয়েছিল। আর এ কারণে বিস্ফোরকগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নতুন এই পেজারগুলোর মধ্যে তিন গ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক লুকানো ছিলো বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ওয়াকিটকি ও ওয়াকিটকি রেডিও কেন বিস্ফোরিত হচ্ছে
আবারও বলতে হয়, ওয়াকিটকি এবং ওয়াকিটকি রেডিও বিস্ফোরণের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। গতকালের বিস্ফোরণের সঙ্গে যদি আগের দিন পেজার বিস্ফোরণের ঘটনার মিল থাকে, তবে কিছু পর্যবেক্ষক বিস্মিত হবেন।

এই পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় এসব যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একটা যোগসাজশ আছে। যন্ত্রগুলোতে ১ থেকে ৩ গ্রাম শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা হয়ে থাকতে পারে; যেমনটা ঘটেছে পেজারের ক্ষেত্রে। তবে কিছু হিজবুল্লাহ সদস্যের ধারণা, এসব বিস্ফোরণ যন্ত্রগুলোর ব্যাটারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে এক দাফন অনুষ্ঠানে একটি বিস্ফোরণের পর সেখানে উপস্থিত লোকজন দ্রুত তাঁদের সঙ্গে থাকা ওয়াকিটকি রেডিওর ব্যাটারি খুলে ছুড়ে ফেলতে থাকেন।

যেসব যন্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলো মূলত যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সৌর প্যানেলের মতো যন্ত্রেও বিস্ফোরণ ঘটার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত এমন এক ঘটনায় একটি মেয়ে আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

গত দুদিনের বিস্ফোরণের ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হিজবুল্লাহ ও লেবানন সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল। কিন্তু গতকাল বিস্ফোরণের ঘটনার পর নিজেদের সেনাদের প্রশংসা করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা পর্বে রয়েছি। এখন আমাদের সাহস, সংকল্প ও উদ্যম দরকার।’

নিজেদের সেনাদের উদ্দেশে দেওয়া ওই বক্তৃতায় গ্যালান্ট ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রশংসা করে বলেন, ‘(আপনাদের কাজের) ফলাফল বেশ চমৎকার।’

হামলার জন্য কেন পেজারকেই বেছে নেওয়া হল ?
তাদের অবস্থান আড়াল করে রাখার জন্য মোবাইল ফোনের বদলে পেজার ব্য়বহার করেন হিজবুল্লার সদস্যরা ৷ তারা যেখানে যান, যোগাযোগের জন্য এই ডিভাইসটি সঙ্গে করে নিয়ে যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যত সেকারণেই ঝাঁঝালো হামলার জন্য পকেটের ভিতরের এই ছোট্ট ডিভাইসটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

তবে আছে প্রশ্ন

হিজবুল্লাহ মূলত পশ্চিমাবিরোধী গোষ্ঠী। তাই যন্ত্র কেনাকাটায় তাদের পশ্চিমা কোনো দেশ বা এর মিত্রদের ওপর নির্ভর করার বিষয়টি অনেক নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলছে। তারা বলছেন, উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাকালীন পেজারে বিস্ফোরক বসিয়ে দেয় মোসাদ। এতে নির্মাতাদেরও যোগসাজশ ছিলো বলেই মনে করছে তারা। তাদের দাবি, হিজবুল্লাহর বেলায় পশ্চিমা প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই হামাস চাইনিজ হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে। হিজবুল্লাহ এখানে ব্যতিক্রম পথে হাঁটলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তারা।

ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা, এম ১৬’র এজেন্টরা স্বীকার করেছেন যে হামাসকে ট্র্যাক করা প্রায় অসম্ভব ছিল কারণ হুয়াওয়ে এবং অন্যান্য চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি তাদের ফার্মওয়্যারে ব্যাকডোর অ্যাক্সেসের অনুমতি দেয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক পরামর্শক এডওয়ার্ড স্নোডেনও এই বিস্ফোরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার জিজ্ঞাসা, পেজারে বিস্ফোরক বসানো ছিলো নাকি এগুলো হ্যাক করা হয়েছে? তার মতে, অতিরিক্ত উত্তপ্ত ব্যাটারি বিস্ফোরিত হলেও আরও অনেক ছোট অগ্নিকাণ্ড দেখা যেতো। সবমিলিয়ে লেবাননে আসলে কি ঘটেছে এবং ঘটছে, সে নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। কেউ নির্দিষ্ট হয়ে কিছুই বলতে পারছে না।